জন্মের পর মা-বাবার অকৃত্রিম স্নেহ-ভালোবাসার মাধ্যমে সন্তান বড় হয়। ঠিক একইভাবে শিক্ষকরা শিক্ষাদানের মাধ্যমে তাদের শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। একজন মানুষকে সৎ, সাহসী, সুশৃঙ্খল ও পরিশ্রমী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। আদর, শাসন এবং নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে পারে। শিক্ষকরা জীবনবোধের শিক্ষা দেন, যার দেখানো পথেই উন্নতির আলো দেখা যায়। তাই শিক্ষকরা শ্রদ্ধার আসনে থেকে যান আজীবন। জীবনের আলো নিভে গেলেও, কৃতজ্ঞতা জেগে থাকে তার প্রতি।
তেমনি একজন শিক্ষক ছিলেন আব্দুল্লাহ মিয়া। যিনি জামালপুর জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের এক মাদারগঞ্জ উপজেলার ঘুঘুমারি গ্রামের অজপাড়াগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তার কল্যাণে পরিবার থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে একটি অঞ্চল শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছিল। তাকে দেখে সাধারণ মানুষ সম্মানের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন, অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা অনেকে ভয়ে সামনেই যেতে চাইতেন না।
আব্দুল্লাহ মিয়া ১৯৬৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জেলার মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রয়াত হওয়ার প্রায় ২০ বছর আগে অবসরে গেলেও এখনো চায়ের আড্ডা, বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর ছাত্রদের আলোচনায় থাকেন আব্দুল্লাহ স্যার।১৯৪৩ সালে জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার কড়ইচুড়া ইউনিয়নের ঘুঘুমারি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শিক্ষক আব্দুল্লাহ মিয়া। স্কুলশিক্ষক আব্দুল খালেক মিয়ার ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম সন্তান। শিক্ষাজীবনের শুরুতে মাদারগঞ্জের মহিষবাথান জুনিয়র মাদরাসা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর ১৯৫৭ সালে বালিজুড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাস করেন। ১৯৫৯ সালে জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে একই কলেজ থেকে ১৯৬১ সালে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।ছাত্রজীবন থেকেই আব্দুল্লাহ মিয়া ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ছোট ভাইদের পড়াশোনার প্রতিও ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্ববান। নিজের অর্থ ও মেধার মাধ্যমে তার ছোট আটজন ভাইকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তিনি ১৯৬১ সালে ডিগ্রি সম্পন্ন করে একই বছর মাদারগঞ্জের ঝাড়কাটা উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকরি শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে ৩২৫ টাকা বেতনে মেলান্দহের মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সর্বশেষ তিনি মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তাকে সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে আব্দুল্লাহ স্যার নামেই ডাকতেন। অবসর-পরবর্তী সময়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মাহমুদপুর এলাকায় ‘নতুন কুঁড়ি বিদ্যাপীঠ’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।আব্দুল্লাহ স্যার একজন আদর্শ শিক্ষক। তাই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন 'শিক্ষাগুরু' হিসেবে। তিনি ছিলেন জ্ঞানের বাতিঘর। ক্লাসের পাঠদানের সময় অত্যন্ত সময়নিষ্ঠ ও যত্নবান ছিলেন। অনর্গল বক্তার মতো সাবলীলভাবে পাঠদান করাতেন। ঘণ্টা পেরিয়ে সময় যে কখন শেষ হতো তা টেরই পেত না শিক্ষার্থীরা। তিনি ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অন্যতম প্রতিভূ। প্রধান শিক্ষক হয়েও তিনি শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ও বাংলা বিষয়ে পাঠদান করাতেন। তার শাসনের ফলেই মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তৈরি হয়েছে অসংখ্য শিক্ষিত মানুষ, যারা প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ে সেবায় নিয়োজিত ছিলেন।
মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও জামালপুরের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. ফজলুল হক বলেন, প্রয়াত প্রধান শিক্ষক শ্রদ্ধেয় আব্দুল্লাহ স্যার শিক্ষার্থীদের যখন পড়াতেন তখন একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি ওই ছাত্রের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করতেন। কীভাবে পাঠদান করালে শিক্ষার্থীরা সহজে বুঝবে ও মনে রাখতে পারবে সেদিকে তার ব্যাপক মনোযোগ ছিল। তার পড়ানোর পদ্ধতি অত্যন্ত চমৎকার ছিল। তার অবদানের ফলেই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করে সিভিল সার্জন হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। শুধু আমাদের বন্ধুমহল নয়, এখনো হাটে-বাজারে চায়ের আড্ডায় প্রয়াত আব্দুল্লাহ স্যারের স্মৃতিচারণ শুনতে পাই। উনি আমাদের মাঝে দীর্ঘকাল স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবেন।মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক বিএসসি তার স্মৃতিচারণ করে বলেন, আব্দুল্লাহ স্যারের সঙ্গে দীর্ঘদিন একই বিদ্যালয়ে চাকরি করেছি। তিনি কঠোরতা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় জেলার মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। প্রত্যেক ছাত্রকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন আবার শাসনের দিক থেকে তিনি কোনো ধরনের ছাড় দিতেন না। তার কথা ছিল—শাসন না করলে ছাত্রদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া যাবে না। উনি যদি বিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যেতেন, তখন শিক্ষার্থীরা নীরব হয়ে যেত, আর শ্রেণিকক্ষে কোনো শিক্ষার্থী আছে কিনা তা জানা যেত না। আজও পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি তার সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে পারে নাই। অনেক শিক্ষকের সঙ্গে চাকরি করেছি, কিন্তু আব্দুল্লাহ স্যারের মতো আর দ্বিতীয়টি পাইনি।
প্রয়াত আব্দুল্লাহ মিয়ার ছোট ভাই ও জামালপুর সদর উপজেলার দিগপাইত কলেজের সহকারী অধ্যাপক নুরুল হুদা বলেন, শুধু বড় ভাই নয়, উনি ছিলেন আমাদের শিক্ষক, বন্ধু ও অর্থযোগানদাতা। তার কল্যাণেই আজ আমাদের পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের বিয়েটাও অনেক দেরিতে করেছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি শাসনের দিক থেকে আমাদের জন্য অনেক কঠোর ছিলেন। প্রতিটি সময় তার অনুপস্থিতি খুব অনুভব করি।
পারিবারের দায়িত্ব আর শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত থেকে ১৯৮৭ সালে মাদারগঞ্জ উপজেলার সুখনগরী গ্রামের মির্জা রুহুল আমিনের মেয়ে রহিমা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সংসার জীবনে তার দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে আয়াত ই রাব্বী বেসরকারি এনআরবিসি ব্যাংকের উপজেলা ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। ছোট ছেলে আনায়াম ই রাব্বী জিনিয়াস জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে কর্মরত আছেন।আব্দুল্লাহ মিয়ার ছোট ছেলে আনায়াম ই রাব্বী জিনিয়াস বলেন, একজন বাবা হিসেবে তিনি আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করলেও শাসনের কমতি ছিল না। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় গেলে সবাই তাকে স্যার সম্বোধন করতেন। এজন্য মাঝে মাঝে আমরাও তাকে 'স্যার' ডেকে ফেলতাম। রাস্তায় বা কোথাও গেলে অনেক মানুষ বাবার কথা বলে, এজন্য অনেক ভালো লাগে। বিভিন্ন সময় বাবার ছাত্র ও অনুসারীরা বাসায় আসেন ও ফোন করে আমাদের খোঁজ নেন। সব মিলিয়ে বাবা এখনো মানুষের মাঝে আলোচনায় আছেন।
মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (অ্যাকাডেমিক দায়িত্ব) সুলতান মাহমুদ বলেন, একাধারে আব্দুল্লাহ স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক এবং আমি তার সঙ্গে দীর্ঘদিন চাকরি করেছি। তার চলে যাওয়ার পর থেকে স্কুলের কার্যক্রম অনেকটাই আর আগের মতো নেই। তার অবসরজনিত বিদায় স্কুলের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা ফিরে পাওয়ার মতো না। এখনো প্রতিদিন বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে আব্দুল্লাহ স্যারকে নিয়ে আলোচনা হয়।
২০২০ সালের ২০ আগস্ট তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। 'কীর্তিমানের মৃত্যু নেই'—তিনি মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবেন একজন আদর্শ শিক্ষক ও সজ্জন ব্যক্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে। কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।