ঢাকা | বঙ্গাব্দ

নারীঘটিত অপরাধে ন্যায়সঙ্গত বিচার

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Mar 17, 2025 ইং
ছবির ক্যাপশন:
ad728

জোরপূর্বক ব্যভিচার বা ধর্ষণ শুধু ব্যক্তি ও নৈতিকতার পরিপন্থী নয়; এটি মানবাধিকার, নারীর মর্যাদা ও সামাজিক নিরাপত্তার ওপর আঘাত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিচারিক সিদ্ধান্ত থেকে আমরা এর সঠিক দিকনির্দেশনা পাই। ওয়াইল ইবনে হুজর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি একদিন নামাজের জন্য মসজিদগামী এক নারীর একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে পালিয়ে যায়। ভুলবশত অন্য এক ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরে ফেলা হয় এবং তার শাস্তি কার্যকরের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কিন্তু তখন প্রকৃত অপরাধী নিজেই নিজের দোষ স্বীকার করে নেয়। ফলে রাসুল (সা.) তাকে রজম তথা প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের আদেশ দেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১৪৫৪)

এ থেকে প্রতীয়মান হয়, ধর্ষণ নিছক শরিয়তের লঙ্ঘন নয়, বরং এক নারীর পবিত্রতা, মর্যাদা ও মানসিক স্থিতি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়।

ধর্ষণ সম্পর্কে ফকিহদের দৃষ্টিভঙ্গি 

সাহাবি ও তাবেয়িদের যুগে ধর্ষণের শাস্তি নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। খলিফা আবু বকর (রা.) এক মামলায় নির্দেশ দিয়েছিলেন যে অপরাধীকে বাধ্য করা হবে যেন সে ভুক্তভোগী নারীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অন্যদিকে উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) ও প্রসিদ্ধ তাবেয়ি হাসান বসরি (রহ.)-এর মতে, শুধু শাস্তি প্রয়োগ করাই যথেষ্ট নয়; অপরাধীকে দাসত্বে পরিণত করে সেই নারীর অধীনে রাখা উচিত, যার ওপর সে জুলুম করেছিল। (মুসান্নাফে আবি শাইবা, হাদিস: ২৮৪২৩)

প্রখ্যাত তাবেয়ি সুদ্দি (রহ.) বলেন, যদি কেউ পরিকল্পিতভাবে কোনো নারীর পিছু নেয় এবং তাকে ধর্ষণ করে, তবে তার একমাত্র শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। তিনি উক্ত রায়ের সপক্ষে সুরা আহজাবের ৬১ নং আয়াতের আলোকে দলিল পেশ করেছেন : ‘যেখানেই তাদের পাওয়া যাবে, পাকড়াও করা হবে এবং নির্মমভাবে হত্যা করা হবে।’ অতপর তিনি বলেন, কোরআনে এমন এক বিধান আছে, যা বাস্তবায়ন হয় না। যদি কোনো ব্যক্তি বা একদল মানুষ মিলে কোনো নারীর পথ রোধ করে, তাকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন (ধর্ষণ) করে, তবে তাদের শাস্তি শুধু বেত্রাঘাত বা প্রস্তর নিক্ষেপ নয়; বরং তাদের ধরে এনে নির্মমভাবে শাস্তি দিতে হবে—তাদের গর্দান দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, যাতে অন্যায়ের বিষবৃক্ষ চিরতরে উপড়ে ফেলা যায়। (রুহুল মাআনি, খণ্ড ২২, পৃষ্ঠা : ৯২)

হানাফি মাযহাবের ফকিহরা বলেন, বলপূর্বক ব্যভিচারের (ধর্ষণ)-এর কঠোর শাস্তি (হদ) প্রয়োগ করতে হবে। (আল মাবসুত লিস সুরাখসি, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা: ৬১)

বলপূর্বক ব্যভিচারের (ধর্ষণ) মাত্রা ও শাস্তির ধরন

তবে সব ধর্ষণকে সরাসরি হারাবাহ (সন্ত্রাস ও সশস্ত্র দস্যুতা) হিসেবে গণ্য করা ন্যায়সংগত নয়। অপরাধের প্রকৃতি ও ভয়াবহতার ওপর ভিত্তি করে তা বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা প্রয়োজন।

১. যদি কোনো ব্যক্তি ক্ষণিকের আবেগে অন্ধ হয়ে নারীর সম্ভ্রমহানি (ধর্ষণ) করে, তবে এটি নিঃসন্দেহে গুরুতর অপরাধ, কিন্তু এটি পরিকল্পিত অপরাধের সমান নয়। এক্ষেত্রে সাধারণ ব্যভিচারের শাস্তির পাশাপাশি অতিরিক্ত শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ আরোপ করা যেতে পারে।

২. যদি কেউ পূর্বপরিকল্পিতভাবে এবং কৌশলগতভাবে ধর্ষণ সংঘটিত করে, বিশেষত যখন অপহরণও যুক্ত হয়, তখন তা সরাসরি ‘হারাবাহ’ ও ‘ফাসাদ ফিল-আরদ’ (পৃথিবীতে অরাজকতা সৃষ্টি)-এর শামিল।

৩. যৌথভাবে সংঘটিত গণধর্ষণ, নারীদের প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করে লাঞ্ছিত করা, অথবা এমন কোনো অপরাধ যা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করে—এসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগ করা ন্যায়সংগত হবে। (আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা, খণ্ড ১৬, পৃষ্ঠা ২৫৪)

এ ধরনের অপরাধের শাস্তি ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়; বরং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থেও কঠিনতম দণ্ড দেওয়া জরুরি।

সুতরাং, যেসব অপরাধ সরাসরি ‘হারাবাহ’ ও ‘ফাসাদ ফিল-আরদ’ হিসেবে গণ্য হবে, সেসব অপরাধের 
১. অপরাধীদের জনসমক্ষে হত্যা করা।
২. ফাঁসির কাষ্ঠে উঠানো। 
৩. হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা।

শাস্তি হলো—

এ ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কেবল অপরাধীর উপযুক্ত দণ্ডই নয়; বরং এটি সমাজের জন্য কঠোর সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে, যা ভবিষ্যতে এমন পাপাচার প্রতিরোধে সহায়ক হবে। (আসরে হাজির মেঁ ইজতিহাদ, পৃষ্ঠা ১৮৪-১৮৬) 

ধর্ষণের কারণে নারীর মানসিক ও সামাজিক ক্ষতি

বলপূর্বক ব্যভিচার (ধর্ষণ) কেবল শারীরিক ক্ষতি নয়; এটি নারীর মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে। ধর্ষণের শিকার নারীরা Rape Trauma Syndrome-এ ভোগেন, যা দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে একে শুধু সাধারণ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা বা অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুষিয়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়।


নিউজটি আপডেট করেছেন : দৈনিক দুর্বার

কমেন্ট বক্স