আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ১০ মাস পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক-পরবর্তী যৌথ ঘোষণা ছিল রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এ বৈঠক জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিরাজমান অনিশ্চয়তা দূর করতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। রাজনীতিতে অনেকটা চমক দেখানোর মতো ঘটনা ছিল ১৩ জুন লন্ডনে অনুষ্ঠিত এ বৈঠক। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিতে টানাপোড়ন যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছিল, লন্ডন বৈঠকে তা অনেকটা কেটেছে। সরকার এবং বিএনপি উভয় পক্ষ থেকে এ বৈঠক ফলপ্রসূ বলা হয়েছে। উভয় পক্ষ জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার, বিচার, জুলাই সনদসহ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে একমত হয়েছে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমান নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছাড় দিয়ে আগামী বছর রমজানের আগে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে একমত পোষণ করেছেন। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল লন্ডন বৈঠকের মধ্য দিয়ে আশা করা যাচ্ছে সেই দূরত্ব কেটে গেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সুবাতাসের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যা সবার জন্য স্বস্তিদায়ক।
কিন্তু ১৪ জুন শনিবার জামায়াতে ইসলামী লন্ডনের বৈঠক নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, সরকারপ্রধান হিসেবে কোনো একটি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ প্রেস ব্রিফিং নৈতিকভাবে কিছুতেই যথার্থ নয়। প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ প্রেস ব্রিফিং করায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান, সেখানে শুধু কোনো একটি দলের সঙ্গে আলাপ করে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সঠিক বলে বিবেচিত হতে পারে না। জামায়াত আশা করে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ থেকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করবে। সরকারের নিরপেক্ষতা এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে, তা নিরসনকল্পে প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা জাতির সামনে স্পষ্ট করার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, ‘লন্ডনের বৈঠকে নির্বাচনের তারিখসংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, বিচার ও সংস্কার তত গুরুত্ব পায়নি। নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বারবার প্রতীয়মান হচ্ছে। যা অত্যন্ত হতাশাজনক।’ তবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, খেলাফতে মজলিস, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ১২-দলীয় জোটসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই এ বৈঠক নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি শুরু থেকেই ডিসেম্বরের মধ্যে-সম্ভব হলে অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিএনপির শেষ অবস্থান ছিল নির্বাচন কোনোভাবেই ডিসেম্বরের পরে নেওয়া যাবে না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান গ্রহণ করেন। রাজনীতির আরেক বড় শক্তি জামায়াতে ইসলামী রমজানের আগে অথবা এপ্রিল মাসেও নির্বাচন হতে পারে বলে মত দেয়। এনসিপি গণহত্যার বিচার ও সংস্কারের পর নির্বাচন হওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। নির্বাচন নিয়ে তিন রাজনৈতিক পক্ষের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে। অন্যদিকে জাপান সফরের সময় প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শুধু একটি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যে বিএনপি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। এরপর পবিত্র ঈদুল আজহার আগের দিন ৬ জুন দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রফেসর ইউনূস আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন। বিএনপি এ ঘোষণায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে। দলটির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। তবে জামায়াতে ইসলামী প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। এনসিপি নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কার দৃশ্যমান করার দাবি পুনরুল্লেখ করে। ফলে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন ঘিরে তৈরি হয় ধোঁয়াশা ও অনিশ্চয়তা। নির্বাচনের সময় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব আরও বাড়ে।