ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এই যুদ্ধকে ‘প্রি-এম্পটিভ’ বা আগাম প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করেছেন, যার লক্ষ্য তেহরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখা। এতে তিনি সেই একই কৌশলগত ভুল করেছেন, যা একসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার করেছিলেন ইরাকে আগ্রাসনের সময়।
ইসরায়েলি জেট ও ক্ষেপণাস্ত্র যখন মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে ইরানি সামরিক ঘাঁটি ও নেতাদের ওপর আঘাত হানে, তখন তা গোটা বিশ্বকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে। যেমনটি ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের ইরাক আক্রমণের সময়। এই অনাক্রমণাত্মক হামলা ইতিমধ্যেই একটি অস্থির অঞ্চলে আরও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে।
নেতানিয়াহুর দাবি, হামলাগুলোর লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা। এ পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফোর্ডোর তিনটি স্থাপনায় আঘাত হেনেছে, যেগুলোতে বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতি হয়েছে। তবে এ হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামাতে পারবে না—এ বিষয়টি নেতানিয়াহু ভালো করেই জানেন।
নাতাঞ্জ স্থাপনাটি ইরান এমনভাবে মাটির গভীরে নির্মাণ করেছে, যা কেবলমাত্র সবচেয়ে শক্তিশালী বাংকার-ধ্বংসকারী বোমা দিয়েই ধ্বংস করা সম্ভব। আর এমন বোমা—যেমন ম্যাসিভ ওরডন্যান্স পেনেট্রাটর (Massive Ordnance Penetrator বা MOAB) ইসরায়েলের নেই। এই অস্ত্র কেবল যুক্তরাষ্ট্রই তৈরি করে এবং বহুবার অনুরোধের পরও যুক্তরাষ্ট্র তা ইসরায়েলকে দেয়নি, এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনও নয়।
হামলার পর মার্কিন প্রতিক্রিয়া বিভ্রান্তিকর। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রথমে এটিকে একটি ‘একতরফা’ ইসরায়েলি অভিযান বলে দূরত্ব বজায় রাখে, যদিও কিছু পরেই ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আসল ভূমিকা এবং অনুমোদনের মাত্রা এখনো পরিষ্কার নয়, তবে এটা নিশ্চিত যে এই হামলার মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে—যা স্বল্পমেয়াদে নেতানিয়াহুর জন্য এক কূটনৈতিক জয়।
তবে ইরানের বিরুদ্ধে আরও বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে চাইলে ইসরায়েলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি এই যুদ্ধে যুক্ত করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনে অনেকেই আমেরিকান হস্তক্ষেপবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এমনকি ট্রাম্প নিজেও চায় না আমেরিকা আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ শুরু করুক।
এদিকে ইসরায়েলের এই হামলা ইতিমধ্যেই বিশ্ববাজারে তেলমূল্য বাড়িয়েছে এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক জটিল করে তুলেছে, কারণ হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে তেল পরিবহন বিঘ্নিত হলে তারা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে।
যদি ইসরায়েল যুদ্ধজয়ী হিসেবে দেখা যায়, তবে ট্রাম্প নিশ্চয়ই সেই কৃতিত্ব নিজের বলে দাবি করবেন। কিন্তু যদি নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রকে জোর করে এই যুদ্ধে টেনে আনার ওপর নির্ভর করে, তবে সেই কৌশল ট্রাম্পের বিরাগ ডেকে আনতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, যদি ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করে, তাহলে ইরানে আর কোনো বড় সাফল্য অর্জনের জন্য তাদের যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই নির্ভর করতে হবে।
নেতানিয়াহুর দ্বিতীয় ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ইরানি শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করা। কিন্তু সেটিও কার্যত অসম্ভব। কিছু উচ্চপদস্থ ইরানি সামরিক নেতা নিহত হলেও এবং ইসরায়েল প্রকাশ্যে ইরানিদের নিজ সরকারের বিরুদ্ধে ওঠে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালেও, ইসরায়েলের একতরফা আগ্রাসন ইরানিদের মধ্যে তাদের সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং তেল আবিবের বিরুদ্ধেই আরও ক্ষোভ সৃষ্টি করবে।
বরং, ইরানি সরকার এখন পারমাণবিক অস্ত্রকে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি যৌক্তিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে, যেটা আগে ঘরোয়া সমালোচকরা মানতে চায়নি। এবং যেসব অঞ্চলে ইরানি প্রভাব কমে গিয়েছিল, সেখানেও নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ড ইরানপন্থী জোটগুলিকে আবার চাঙা করে তুলতে পারে।
তবে এমনকি যদি তেহরানকে অস্থির করতেও সক্ষম হয় ইসরায়েল, তবু সেটি অঞ্চলজুড়ে শান্তি আনবে না—এটাই ছিল ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। সেই পতনের ফলেই চরমপন্থা বেড়ে গিয়ে আইএস-এর মতো গোষ্ঠীর জন্ম হয়, যারা ২০১০-এর দশকে গোটা অঞ্চলজুড়ে সন্ত্রাস ছড়িয়েছিল।
ইসরায়েলের পক্ষে কখনওই তেহরানে একটি অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, এবং এমন প্রচেষ্টায় ইরান দখল করাও অসম্ভব, কারণ দেশ দুটি পরস্পরের প্রতিবেশী নয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এমন সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনাও কম, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে।
অর্থাৎ, নেতানিয়াহুর এই হামলা স্বল্পমেয়াদে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমে বিলম্ব আনতে পারে বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে এক ভয়াবহ কৌশলগত বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র: আলজাজিরা
নিউজটি আপডেট করেছেন : বার্তা সম্পাদক